হজ্ব ও উমরার বর্ণনা

3320

হজ্বের বর্ণনা

হজ্বের কাজসমূহ যিলহজ্বের আট তারিখ থেকে শুরু করতে হবে। আর তা হবে নিম্নবর্ণিতভাবে:

যিলহজ্বের আট তারিখ ( য়াউমুত তারবিয়া)

১ - হাজ্বী যে স্থানে অবস্থান করছে সে স্থান থেকেই ইহরাম বাঁধবে, অতঃপর গোসল করবে, আতর লাগাবে, ইহরামের কাপড় পরিধান করবে এবং বলবে:

لبيك اللهم حجاً، لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك، إن الحمد والنعمة لك والملك، لا شريك لك

২- «হে আল্লাহ, হজ্ব আদায়ের জন্য আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই প্রশংসা ও নেয়ামত আপনার এবং রাজত্বও, আপনার কোনো শরিক নেই।

যিলহজ্বের নয় তারিখ ( আরাফা দিবস)

১ - সূর্যোদয়ের পর হাজ্বী আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হবে। আরাফায় গিয়ে যোহর ও আসর- যোহরের সময়- একত্রে কসর করে পড়বে। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে সূর্য ঢলে যাওয়ার পূর্বে নামিরায় অবস্থান নেবে|

২ - নামাজের পর যিকর ও দুআর জন্য ফারেগ হয়ে যাবে। কিবলামুখী হয়ে হাত উঠিয়ে দুআ করবে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানেই অবস্থান করবে|

৩ - সূর্যাস্ত সম্পন্ন হলে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হবে। মুযদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশা একসাথে আদায় করবে। এশার নামাজ কসর করে দু রাকাত আদায় করবে। মুযদালিফায় রাতযাপন করবে। সূর্যোদয়ের কিছুসময় পূর্ব পর্যন্ত মুযদালিফাতেই অবস্থান করবে।

১০ যিলহজ্ব

১ - ফজরের নামাজ পড়বে, অতঃপর যিকর ও দুআয় সূর্যোদয়ের কিছু সময় পূর্ব পর্যন্ত মশগুল থাকবে।

২ - সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনার দিকে রওয়ানা হবে।

৩ - মিনায় পৌঁছার পর জামরায়ে আকাবা তথা বড় জামরায় যাবে। বড় জামরাকে লক্ষ্য করে সাতটি কঙ্কর মারবে। একটির পর একটি বিরতিহীনভাবে মারবে। প্রতিটি কঙ্ককরের সাথে তাকবির দেবে|

৪ - হাদী যবেহ করবে যদি হাদী যবেহ করা আবশ্যক হয়ে থাকে।

৫ - মাথার চুল মুণ্ডাবে অথবা ছোট করবে। এ সবের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে যাবে, অতঃপর স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে। এ সময় থেকে স্বামীস্ত্রীর মিলন ব্যতীত ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ অন্যসব বিষয় হালাল হয়ে যাবে।

৬ - এরপর মক্কায় ফিরে যাবে ও তাওয়াফে ইফাযা তথা হজ্বের ফরজ তাওয়াফ সম্পন্ন করবে। তামাত্তু হজ্বকারী হলে সাফা-মারওয়ার সায়ীও করবে। তামাত্তু হজ্বকারী না হলেও সাফা-মারওয়ার সায়ী করবে যদি তাওয়াফে কুদূমের সাথে সায়ী করে না থাকে। এর মাধ্যমে হাজ্বী পূর্ণাঙ্গরূপে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে যাবে। এখন থেকে তার জন্য ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সকল বিষয় হালাল হয়ে যাবে।

৭ - এরপর মিনায় ফিরে আসবে এবং সেখানে রাতযাপন করবে।

এগারো যিলহজ্ব (আইয়ামে তাশরীকের প্রথম দিন)

১ - তিন জামরার প্রতিটিতে কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। প্রতি জামরায় সাতটি কঙ্কর বিরামহীনভাবে মারবে এবং প্রতি কঙ্করের সাথে তাকবির দেবে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়ার পর অর্থাৎ যোহরের সময় কঙ্কর মারবে। এর পূর্বে কঙ্কর মারলে তা জায়েয হবে না। প্রথম ও মধ্য-জামরায় কঙ্কর মারার পর দুআ করবে।

ফিকাহবিদদের কেউ কেউ কঙ্করের আকৃতি নির্ধারণ করে বলেছেন, যে তা চনাবুটের চেয়ে একটি বড় ও আখরুট থেকে একটু ছোট।

২ - মিনায় রাতযাপন করবে

বারো যিলহজ্ব (আইয়ামে তাশরীকের দ্বিতীয় দিন)

এর পূর্বের দিন যেভাবে কঙ্কর মেরেছে ঠিক সেভাবেই তিন জামরায় কঙ্কর মারবে।

যদি দ্রুত মিনা ত্যাগ অর্থাৎ বারো তারিখেই মিনা ত্যাগের ইচ্ছা থাকে তাহলে আজই সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। আর যদি তেরো তারিখেও কঙ্কর মারার ইচ্ছা থাকে তবে বারো তারিখ দিবাগত রাত মিনাতেই যাপন করতে হবে।

বিদায়ী তাওয়াফের জন্য মক্কায় যাবে যদি মক্কা ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে।

তেরো যিলহজ্ব (আইয়ামে তাশরীকের শেষ দিন)

এ দিনটি, দেরি করে মিনা পরিত্যাগকারীর জন্য সুনির্দিষ্ট। এ দিনে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো করবে:

১ - তিন জামরায় এর পূর্বের দুইদিনের মতোই কঙ্কর মারবে।

২- মিনা থেকে বের হয়ে যাবে এবং মক্কা ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে বিদায়ী তাওয়াফ করবে।

এর মাধ্যমে হজ্বকর্মের সবগুলোই সম্পন্ন হয়ে যাবে।

উমরার বর্ণনা

১- উমরাকারী যখন মিকাতে পৌঁছবে, সে গোসল করবে, আতর লাগাবে, ইহরামের উত্তম কাপড় পরিধান করবে এবং উমরার নিয়ত করবে এবং বলবে: (হে আল্লাহ আমি উমরার জন্য হাজির)

তালবিয়া পাঠ আরম্ভ করবে ও বলবে:

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيكَ لَكَ

«আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি হাজির, আমি হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই প্রশংসা ও নেয়ামত আপনার এবং রাজত্বও, আপনার কোনো শরিক নেই।»

যতক্ষণ বায়তুল্লাহ না দেখবে ও হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ অব্যাহত রাখবে।

৩- মসজিদে প্রবেশের দুআ পড়ে ডান পা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে।

৪ - তালবিয়া বন্ধ করে দেবে এবং কাবাঘরের তাওয়াফ শুরু করবে। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ অথবা চুম্বন - যদি সম্ভব হয়- অথবা হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করবে ও বলবে:

بسم الله والله أكبر، اللهم إيماناً بك، وتصديقاً بكتابك، ووفاءً بعهدك، واتباعاً لسنة نبيك محمد

(আল্লাহর নামে শুরু করছি। আর আল্লাহ সবথেকে বড়। হে আল্লাহ আপনার প্রতি ঈমান রেখে, আপনার কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রেখে, আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে এবং নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নতের অনুসরণে।)

- কাবাঘরকে নিজের বামদিকে রেখে সাতবার তাওয়াফ করবে। হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করবে ও হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত এসে শেষ করবে।

- পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল তথা দ্রুত চলা সুন্নত।

- তাওয়াফ কালে নিজের ইচ্ছামতো দুআ করবে। যখন রুকনে য়্যামানীর বরাবর পৌঁছবে তা স্পর্শ করবে ও তাকবির দেবে। আর যদি স্পর্শ করতে না পারে তবে হাতে ইশারা করবে না, তাকবিরও দেবে না। রুকনে য়্যামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যমর্তী স্থানে বলবে: ربنا آتنا في الدنيا حسنةً، وفي الآخرة حسنةً، وقنا عذاب النار (হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।)

- তাওয়াফের পর মাকামে ইবরাহীমের পেছনে - যদি সম্ভব হয়- দু রাকাত নামাজ পড়বে। আর সম্ভব না হলে মসজিদুল হারামের যেকোনো স্থানে পড়ে নেবে।

- এরপর সাফা পাহাড়ের দিকে যাবে। সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে কুরআনুল কারীমের এ আয়াতটি পড়বে:


(إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖفَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ)

{নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে বাইতুল্লাহর হজ্জ করবে কিংবা উমরা করবে তার কোনো অপরাধ হবে না যে, সে এগুলোর তাওয়াফ করবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কল্যাণ করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ভালো কাজের পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।} [সূরা আল বাকারা:১৫৮]

- সাফা পাহাড়ে ওঠবে। কিবলামুখি হবে। দু হাত ওঠাবে। তাকবির দেবে ও আল্লাহর প্রশংসা করবে। বলবে,

لَا إِلَهَ إِلَّا الله وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ، صَدَقَ الله وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ

(আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন এবং সকল বিষয়ের ওপর তিনি ক্ষমতাবান। আমরা গুনাহ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী, আমাদের রবের সম্মুখে সিজদাকারী ও তাঁর প্রশংসাকারী। আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন ও তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুদেরকে পরাজিত করেছেন।)

এরপর নিজের প্রার্থনা আল্লাহর কাছে ব্যক্ত করবে। এরপর উল্লিখিত দুআটি দ্বিতীয়বারের মতো পড়বে। এরপর আবার নিজের প্রার্থনা আল্লাহর কাছে ব্যক্ত করবে ও তৃতীয়বারের মতো উল্লিখিত দুআটি পড়বে।

১১ - সাফা থেকে নেমে মাওরয়ার পথে রওয়ানা হবে। দুই সবুজচিহ্নের মাঝে দ্রুতপদে ধাবমান হবে। মারওয়ায় ওঠবে এবং সাফায় যেভাবে দুআ প্রার্থনা করেছে, একইরূপে মারওয়াতেও করবে।

১১- সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাতবার সায়ী করবে।

১২- সায়ী করার পর পুরুষ তার মাথার চুল ছোট করবে। এমনভাবে চুল ছোট করবে যে সমগ্র মাথা থেকেই চুল ছোট করা হয়েছে বিষয়টি যেন পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। নারীরা সমগ্র মাথার চুল একত্রে ধরে হস্তাঙ্গুলির মাথা পরিমাণ কেটে ফেলবে।

পুরুষের ক্ষেত্রে মাথার চুল মুণ্ডন করা উত্তম। আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: «হে আল্লাহ, আপনি মাথা মুণ্ডনকারীদেরকে ক্ষমা করে দিন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আর চুল ছোটকারীদের জন্যে? তিনি বললেন,«হে আল্লাহ, আপনি মাথা মুণ্ডনকারীদেরকে ক্ষমা করে দিন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আর চুল ছোটকারীদের জন্যে? এভাবে তিনি তিনবার বললেন। এরপর বললেন, «চুল ছোটকারীদেরকেও ক্ষমা করে দিন।»

১৪ - এরপর ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উমরার যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে।