হায়েয, ইস্তেহাযা ও নিফাস

40986

 

হায়েয

আভিধানিক অর্থে হায়েয

কোনো কিছু প্রবাহিত হওয়া

শরীয়তের পরিভাষায় হায়েয

নারীর সুস্থ জরায়ু থেকে সুনির্দিষ্ট সময়ে, কোনো কারণ ব্যতীতই যে রক্তস্রাব বের হয় তাকে হায়েয বলে।

হায়েযের রক্তস্রাবের ধরণ

কালো, যেন তা পুড়ে-যাওয়া কৃষ্ণ কোনো পদার্থ, কষ্টদায়ক, দুর্গন্ধযুক্ত, এবং এ সময় নারী প্রচন্ড তাপ অনুভব করে।

হায়েয শুরু হওয়ার বয়স

হায়েয শুরু হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। নারীর প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী তা ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই নারী যখন হায়েযের স্রাব দেখে তখন সেটাকেই হায়েয ধরা হবে।

হায়েযের সময়সীমা

হায়েযের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। নারীদের কারও তিনদিন, আবার কারও চারদিন হায়েয হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হায়েয ছয় অথবা সাতদিন হয়ে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হামনা বিনতে জাহাশকে বলেছেন, যার অনেক দিন হায়েয হতো, ‘তুমি আল্লাহর ইলম অনুযায়ী ছয়দিন অথবা সাতদিন হায়েয গণনা করো, অতঃপর গোসল করো।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

মাসায়েল

১. মূলত গর্ভবতী নারীর হায়েয হয় না। তাই যদি কোনো নারী প্রসবের অল্প কিছু সময় পূর্বে রক্ত দেখে এবং জরায়ুতে প্রসবের ব্যাথা অনুভব হয়, তবে তা নিফাসের রক্ত। আর যদি প্রসবের ব্যাথা অনুভূত না হয় এবং তা বেশ কিছু দিন পূর্বে হয়, তবে তা হায়েযের রক্ত বলে গণ্য হবে।

২. কোনো নারীর নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে যদি হায়েয আসে, যেমন মাসের শুরুতে হায়েয আসার কথা কিন্তু তার পরিবর্তে হায়েয এলো মাসের শেষে। অথবা সুনির্দিষ্ট সময়ের কম অথবা বেশি হলো, যেমন সাধারণত ছয়দিন হায়েয হয়, তবে এবার হলো সাতদিন। এরূপ হলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হবে না। বরং যখন হায়েযের রক্ত দেখা যাবে সেটাকেই হায়েয মনে করা হবে। আর যখন পবিত্রতা দেখা যাবে তখন সেটাকে পবিত্রতা মনে করতে হবে।

৩. নারীর পবিত্র হওয়া বুঝা যাবে সাদা স্রাব নির্গত হওয়ার মাধ্যমে। যদি সাদা স্রাব নির্গত না হয়, তাহলে শুষ্কতা পবিত্রতার আলামত বলে ধরা হবে। যেমন, যদি সাদা তুলা নারীর গুপ্তাঙ্গে রাখা হয় আর তা শুষ্কাবস্থায় বের হয়ে আসে, তবে তা পবিত্রতার আলামত বলে ধরা হবে।

হায়েযের আহকাম

সুফরা

হলুদ রঙ্গের স্রাব।

কুদরা

হলুদ ও কালো রঙ্গের মাঝামাঝি রঙ্গের স্রাব।

১ - কুদরা ও সুফরার হুকুম

যদি কোনো নারী হলুদ রঙ্গের স্রাব দেখে, অথবা হলুদ ও কালোর মাঝামাঝি রঙ্গের রক্ত দেখে অথবা শুধু আদ্রতা দেখে তবে তার দু’অবস্থা হতে পারে:

১ – নারী হয়তো তা হায়েযের সময়সীমার মধ্যে অথবা পবিত্রতা অর্জনের সামান্য পূর্বে দেখবে

এ অবস্থায় তা হায়েয বলে গণ্য হবে; এর প্রমাণ আয়েশা রাযি. এর হাদীস,‘নারীরা তাঁর কাছে ব্যবহৃত তুলা পাঠাত যাতে হুলুদ বর্ণের রক্ত থাকত, অতঃপর তিনি বলতেন, ‘তাড়াহুড়া করো না যতক্ষণ না সাদা স্রাব দেখ। এর দ্বারা তিনি হায়েয থেকে পবিত্রতাকে বুঝিয়েছেন।’(বর্ণনায় ইমাম মালিক)

২ - নারী হয়তো তা পবিত্র অবস্থায় দেখবে

এ অবস্থায় তা হিসাবে আনা হবে না। এরূপ স্রাব এলে অজু ও গোসল কোনোটাই ফরজ হবে না। উম্মে আতিয়া রাযি. বলেন, ‘আমরা পবিত্রতা অর্জনের পর কুদরা ও সুফরাকে হিসাবে আনতাম না।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

২ - ভেঙ্গে ভেঙ্গে হায়েয আসার হুকুম

নারী যদি একদিন রক্ত দেখে, অন্যদিন না দেখে, তবে তার দু’অবস্থা হতে পারে:

১ - অবস্থা সবসময় থাকা

তাহলে তা ইস্তিহাযার স্রাব বলে ধরা হবে।

২ - অথবা কেটে কেটে আসা

অর্থাৎ কিছু সময় আসা আবার কিছু সময় বন্ধ থাকা। এরূপ হলে তার হুকুম হবে নিম্নরূপ:

ক - যদি পুরো একদিনের কম হায়েযের স্রাব না আসে তবে তা হায়েযের মধ্যেই হিসাব করা হবে।

খ - যদি পবিত্রতার সময় নারী এমন জিনিস দেখে যা পবিত্রতাকে নির্দেশ করে যেমন সাদা স্রাব দেখল, তাহলে এ সময়টা পবিত্রতার মধ্যে ধরা হবে। চাই তা কম হোক বা বেশি হোক। অথবা তা একদিনের কম বা বেশি হোক।

ইস্তিহাযা

ইস্তিহাযা

স্ত্রী অঙ্গ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে রক্ত প্রবাহিত হওয়া, অথবা কিছু সময়ের জন্য থেমে আবার প্রবাহিত হওয়া।

হায়েয ও ইস্তিহাযার রক্তের মধ্যে পার্থক্য

হায়েযের রক্ত

ইস্তিহাযার রক্ত

গাড় কালো

হালকা লাল

এর রয়েছে পচা দুর্গন্ধ

এর কোনো গন্ধ নেই

জমাট বাঁধে না

জমাট বেঁধে যায়

জরায়ুর সর্বশেষ প্রান্ত থেকে বের হয়

জরায়ুর মুখে অবস্থিত একটি রগ থেকে বের হয়

স্বাভাবিক ও সুস্থাবস্থার রক্ত

কোনো সমস্যা ও অসুস্থতাজনিত রক্ত

যা সুনির্দিষ্ট সময় নির্গত হয়

যা সুযার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় নেই

প্রথম অবস্থা: ইস্তিহাযার পূর্বে নারীর সুনির্দিষ্ট সময়ে ঋতুস্রাবের অভ্যাস থাকা

এই প্রকৃতির নারী তার ঋতুস্রাবের সুনির্দিষ্ট সময়কে হায়েয হিসেবে বিবেচনা করবে, এবং মাসের বাকি দিনগুলোকে ইস্তিহাযা হিসেবে ধরবে। আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, ফাতেমা বিনতে আবি হুবাইশ রাযি. বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, ‘আমি পবিত্র হই না। অতঃপর আমি কি নামাজ পরিত্যাগ করব?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘না, ওটা হলো শরীরের রক্ত নালী হতে নিসৃত রক্ত সাদৃশ। তবে তোমার যে কয়দিন ঋতুস্রাব হওয়ার অভ্যাস ছিল সে কয়দিন নামাজ ছেড়ে দাও। এরপর গোসল করো ও নামাজ পড়ো।’(বর্ণনায় বুখারী)

দ্বিতীয় অবস্থা : ঋতুস্রাবের জানা কোনো অভ্যাস না থাকা। তবে হায়েয ও ইস্তিহাযার রক্তের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হওয়া।

এই প্রকৃতির নারী তার পার্থক্য করার ভিত্তিতে আমল করবে। ফাতেমা বিনতে আবি হুবাইশ রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি ইস্তিহাযাগ্রস্তা হতেন। অতঃপর রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘যদি হায়েযের রক্ত হয় তবে তা পরিচিত কালো রক্ত হবে। যদি এরূপ হয় তবে নামাজ পড়া থেকে বিরত হও। আর যদি এর অন্যথা হয়, তবে অজু করো ও নামাজ পড়ো; কেননা তা শরীরের রক্ত নালী হতে নিসৃত রক্ত সাদৃশ।’
(বর্ণনায় আবু দাউদ)

তৃতীয় অবস্থা: সুনির্দিষ্ট কোনো অভ্যাস না থাকা এবং পার্থক্য করতেও অক্ষম হওয়া।

এ প্রকৃতির নারী অধিকাংশ নারীদের অভ্যাস মুতাবেক আমল করবে। অতঃপর প্রতিমাসে ছয় অথবা সাতদিন হায়েয হিসাব করবে। স্রাব শুরু হওয়ার প্রথমদিন থেকে হিসাব করবে। আর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো ইস্তিহাযা হিসেবে ধরবে। এর প্রমাণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হামনা বিনতে জাহাশ রাযি. কে বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহর ইলম অনুযায়ী ছয় অথবা সাতদিন হায়েয হিসাব করো, অতঃপর গোসল করো। এরপর যখন দেখবে যে তুমি পবিত্র হয়েছ, তখন তেইশ অথবা চব্বিশদিন নামাজ পড়ো ও রোজা রাখো। এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। প্রতি মাসেই তুমি অনুরূপ করো, অন্যান্য নারীদের মতো অর্থাৎ তাদের হায়েয ও পবিত্রতার সময়ের মতো।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

চতুর্থ অবস্থা : নারীর সুনির্দিষ্ট সময়ে ঋতুস্রাব আসার অভ্যাস থাকা এবং একই সাথে পার্থক্য করতে সক্ষম হওয়া।

এ অবস্থায় অভ্যাসটাকে হিসেবে আনা হবে, পার্থক্য করাটাকে নয়; কেননা অভ্যাসটাই নারীর জন্যে অধিক নিয়মানুবর্তী। তবে যদি নারী ভুলে যায় তার অভ্যাস কি ছিল, এমতাবস্থায় পার্থক্যকরণের ভিত্তির ওপর আমল করা হবে।

মাসায়েল

১. যদি হায়েয সংঘটিত হওয়ার সময় সম্পর্কে নারীর জানা থাকে, তবে কয়দিন হায়েয হয় তা ভুলে যায়, এমতাবস্থায় অধিকাংশ নারীদের অভ্যাস অনুযায়ী সময় হিসাব করতে হবে।

২. কয়দিন হায়েয হয় যদি তা জানা থাকে, তবে তা কখন হয়, মাসের শুরুতে না শেষে তা মনে না থাকে, তাহলে হায়েযের দিনগুলো মাসের শুরুতে হিসাব করবে। যদি মাসের মধ্যখানে হায়েয আসত বলে মনে করতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কবে শুরু হত তা বলতে না পারে, তাহলে মাসের মধ্যখানের প্রথমাংশে হায়েযের সময় হিসাব করবে। কেননা মাসের মাঝখান থেকে হিসাব করা, সময় নিয়ন্ত্রণের জন্য, নারীর পক্ষে সহজ।

যদি হায়েযের সময় চলে যায়, আর নারী ইস্তিহাযাগ্রস্ত থাকে তবে নামাজ রোজা পালন করে যাবে। অজুর পর যদি রক্ত আসে তবে তাতে কোনো ক্ষতি হবে না; কেননা এটাকে ওজর হিসাবে ধরা হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর পবিত্রতা অর্জন তিনভাবে হতে পারে:

ক - নামাজের সময় আসার পর প্রতি নামাজের জন্য অজু করবে। এর প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমা বিনতে আবি হুবাইশকে বলেছেন,‘অতঃপর তুমি প্রত্যেক নামাজের জন্য অজু করো ও নামাজ আদায় করে নাও।
(বর্ণনায় আবু দাউদ)

খ - যোহরের নামাজ একেবারে শেষ ওয়াক্তে পিছিয়ে দেবে। অতঃপর গোসল করে যোহর ও আসর একসাথে আদায় করে নেবে। মাগরিব ও এশা একইরূপে আদায় করবে। এর দলিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হামনা বিনতে জাহাশ রাযি. কে বলেছেন, ‘তুমি যদি পার যোহরের নামাজ পিছিয়ে দিতে ও আসরের নামাজ সময় শুরু হওয়ার সাথে সাথে পড়তে তবে গোসল করে উভয় নামাজ একসাথে জমা করে পড়ে নেবে। অর্থাৎ যোহর ও আসর। আর যদি পার মাগরিব পিছিয়ে দিতে ও এশা প্রথম ওয়াক্তে পড়তে তাহলে গোসল করে দুই নামাজ একত্রে পড়তে পারলে পড়ে নেবে। ফজরের সময় গোসল করে ফজর পড়ে নেবে। আর যদি রোজা রাখতে সক্ষম হও তবে রোজা রাখবে।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

গ- প্রত্যেক নামাজের জন্য আলাদাভাবে গোসল করবে; এক বর্ণনায় এসেছে, উম্মে হাবিবা রাযি. সাত বছর পর্যন্ত ইস্তিহাযাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গোসল করতে নির্দেশ দেন। অতঃপর তিনি প্রতি নামাজের জন্য গোসল করতেন।(বর্ণনায় বুখারী)

৩. যদি কোনো কারণে নারীর রক্তক্ষরণ ঘটে, যেমন জরায়ুতে অস্ত্রপাচার করা হলো, যার ফলে রক্তপাত হলো, এর দু’অবস্থা হতে পারে:

ক - হায়েয আসবে না বলে নিশ্চিত জ্ঞান থাকা। এমতাবস্থায় এটাকে ইস্তিহাযা বলে ধরা হবে না। এ কারণে কোনো ওয়াক্ত নামাজ থেকে বিরত হওয়া যাবে না। এ সময় নির্গত রক্ত অসুস্থতাজনিত কারণে নির্গত রক্ত বলে ধরা হবে। এ অবস্থায় প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জন্য অজু করতে হবে।

৪. হায়েয হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানা থাকা। এ অবস্থায় নির্গত রক্তের হুকুম হবে ইস্তিহাযার মতো।

৫. ইস্তিহাযাগ্রস্ত স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন বৈধ; কেননা শরীয়তে এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি।

নিফাস

নিফাস

নারীর জরায়ু থেকে সন্তান প্রসবের কারণে যে রক্ত বের হয়।

নিফাসের সময়সীমা

নিফাসের সর্বনিম্ন সুনির্দিষ্ট সময় বলতে কিছু নেই। তবে সর্বোচ্চ সময় হলো চল্লিশদিন। তবে যদি নারী এর পূর্বে পবিত্রতা দেখে তবে গোসল করবে ও নামাজ আদায় করবে।

নিফাসের আহকাম

১- প্রসবের পর যদি রক্ত দেখা না যায় - এরূপ অবশ্য খুব কমই ঘটে থাকে -তাহলে অজু করে নামাজ পড়ে নিতে হবে। এ অবস্থায় গোসল করতে হবে না।

২- যদি রক্তস্রাব চল্লিশদিন অতিক্রম করে যায় আর নারীর চল্লিশদিন পর নিফাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভ্যাস থাকে, অথবা অতি দ্রুত বন্ধ হয়ে যাওয়ার আলামত প্রকাশ পায়, তাহলে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি বন্ধ না হয় তাহলে তা ইস্তিহাযা বলে গণ্য হবে। এবং এ ক্ষেত্রে ইস্তিহাযার সকল হুকুম বর্তাবে।

৩- আর যদি চল্লিশদিনের পূর্বেই পবিত্র হয়ে যায়, কিন্তু চল্লিশদিন শেষ হওয়ার আগে আবার ফিরে আসে, তাহলে এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে :

ক - যদি জানা যায় যে তা নিফাসের রক্ত, তাহলে তা নিফাস বলেই গণ্য হবে।

খ - আর যদি জানা যায় তা নিফাসের রক্ত না তবে নারীর এ অবস্থাকে পবিত্রাবস্থা বলে ধরা হবে।

৪- দৃশ্যমান অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গসম্পন্ন মানব সন্তান প্রসবের পর যে রক্তস্রাব বের হয় তাকে নিফাস বলে। আর যদি এমন সন্তান প্রসব হয় যার অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গ দৃশ্যমান নয়, তাহলে এর কয়েকটি অবস্থা হতে পারে:

ক - হয়তো গর্ভ শুরু হওয়ার প্রথম চল্লিশদিনের পূর্বেই গর্ভপাত হবে।যদি এরূপ হয় তবে তা পচা রক্ত বলে ধরা হবে। এমতাবস্থায় নারী নামাজ পড়বে ও রোজা রাখবে।

খ - অথবা আশিদিন পর গর্ভপাত ঘটবে। তাহলে এটাকে নিফাসের রক্ত বলে ধরা হবে।

গ- আর যদি চল্লিশদিন থেকে আশিদিনের মধ্যে গর্ভপাত ঘটে তবে দেখতে হবে, অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গের আলামত প্রকাশ পেয়েছে কি না, যদি আলামত প্রকাশ পেয়ে থাকে তবে তা নিফাসের রক্ত বলে ধরা হবে। অন্যথায় তা পচা রক্ত বলে ধরা হবে।

হায়েয ও নিফাসের কারণে যা কিছু হারাম হয়ে যায়

১ - স্বামী-স্ত্রীর মিলন

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡمَحِيضِۖ قُلۡ هُوَ أَذٗى فَٱعۡتَزِلُواْ ٱلنِّسَآءَ فِي ٱلۡمَحِيضِ وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ ٢٢٢ )
{আর তারা তোমাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা কষ্ট। সুতরাং তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্ল­াহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।} [সূরা আল বাকারাহ: ২২২]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত আয়াত নাযিল হলে বলেছেন, ‘তোমরা সবকিছু করো, কেবল স্বামী-স্ত্রীর মিলন ব্যতীত।’(বর্ণনায় মুসলিম)

মাসায়েল

১- হায়েয অবস্থায় যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হলো সে গুনাহগার। এ ব্যক্তির ওপর কাফফরা দেয়া ওয়াজিব। স্ত্রীর ওপরও কাফফারা ওয়াজিব হবে যদি মিলনের সময় স্ত্রী সম্মত থাকে।

আর এই ক্ষেত্রে কাফফারা হলো, এক দিনার অথবা অর্ধ দিনার পরিমাণ স্বর্ণ দান করা। ইবনে আব্বাস রাযি. এর বর্ণনা অনুযায়ী যে ব্যক্তি হায়েয অবস্থায় স্ত্রীর সাথে মিলিত হলো তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক দিনার বা অর্ধ দিনার পরিমাণ সদকা করবে।’(বর্ণনায় মুসলিম)

একদিনার হলো ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ ।

২- যদি হায়েয থেকে স্ত্রী পবিত্র হয় তবে তার সাথে মিলিত হবে না যতক্ষণ না সে গোসল করে নেয়। ইরশাদ হয়েছে:
( وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ )

{‘তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না।’}
[সূরা আল বাকারা:২২২] এখানে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ )

{অতঃপর যখন তারা (গোসল করে) পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন।}

২- নামাজ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘তোমার যখন হায়েয আসবে তখন নামাজ ছেড়ে দাও, আর যখন হায়েয চলে যাবে তখন রক্ত ধৌত করতে গোসল করো এবং নামাজ আদায় করো।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

মাসায়েল

১- নারী যখন পবিত্র হবে তখন হায়েয অবস্থায় যেসব নামাজ চলে গিয়েছে তা আদায় করতে হবে না। এর প্রমাণ আয়েশা রাযি. কে, হায়েযগ্রস্ত নারী নামাজ রোজা আদায় করবে কি না, এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,‘এ বিষয়টি আমাদের স্পর্শ করত। অতঃপর আমাদেরকে রোজা কাজা করার নির্দেশ দেয়া হত, তবে নামাজ কাজা করার নির্দেশ দেয়া হত না।’
(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

২- পবিত্র হওয়ার পর যদি পূর্ণাঙ্গ এক রাকাত নামাজ পড়া যাবে এমন সময় থাকে তবে তার ওপর ওই ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হবে। হোক তা নামাজের সময় আসার প্রথম অংশে অথবা শেষাংশে। যদি পূর্ণাঙ্গ এক রাকাত নামাজ পড়ার মতো সময় না থাকে, তবে নামাজ পড়া ফরজ হবে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এক রাকাত নামাজ পেল সে পুরো নামাজই পেল।’
(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৩- রোজা

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন নারীর হায়েয আসে তখন সে কি নামাজ রোজা ছেড়ে দেয় না? উত্তরে তারা বলল,‘ জী’।(বর্ণনায় বুখারী)

মাসআলা

হায়েযগ্রস্ত নারী যদি সুবহে সাদেকের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন করে অতঃপর রোজা রাখে, তবে তার রোজা জায়েয হবে, এমনকি যদি সুবহে সাদেকের পর গোসল করে তবুও।

৪- কুরআন স্পর্শ করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, (لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ٧٩ ) {কেউ তা স্পর্শ করবেনা পবিত্রগন ছাড়া,}[সূরা আল ওয়াকিয়া:৭৯]

৫- পবিত্র কাবার তাওয়াফ করা

এর যখন ঋতুস্রাব এল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন,‘হাজ্বী যা করে তা করে যাও, তবে তুমি পবিত্র হওয়ার পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করো না’।
হাদীসটি ইমাম মালিক তার মুয়াত্তায় উল্লেখ করেছেন) ইবনে আব্বাস রাযি. বলেছেন,‘লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে তাদের সর্বশেষ কর্ম যেন হয় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা। তবে তিনি হায়েযগ্রস্ত নারীর জন্য এ ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন।(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৬- মসজিদে অবস্থান করা তবে যদি তা কেবল অতিক্রম করার জন্য হয়

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمۡ سُكَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعۡلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغۡتَسِلُواْۚ )
{হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।} [আন নিসা:৪৩] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি হায়েযগ্রস্ত নারী ও জুনুবির জন্য মসজিদ অবৈধ করিছি।
(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

মাসায়েল

১- হায়েযগ্রস্ত নারী যদি ন্যাপকিন বেঁধে রাখে এবং মসজিদ অপবিত্র হওয়ার ভয় না থাকে তবে মসজিদের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করায় কোনো সমস্যা হবে না। এর প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী, {তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও}[আন নিসা:৪৩]

২- হায়েযগ্রস্ত নারী ঈদের নামাজ পড়ার স্থল থেকে দূরে অবস্থান করবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘হায়েযগ্রস্ত নারীরা ঈদের নামাজ পড়ার স্থল বর্জন করবে।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

৭- তালাক

স্ত্রী হায়েযগ্রস্ত হলে স্বামী কর্তৃক তাকে তালাক দেয়া হারাম হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ )

{হে নবী, (বল), তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তাদের তালাক দাও।}
অর্থাৎ এমন সময় তালাক দেবে যাতে ইদ্দত পালন করার সুনির্দিষ্ট সময় সে সামনে পায়। তবে হায়েযগ্রস্ত নারীকে তালাক প্রদান হারাম ও বিদআত হলেও তা কার্যকর হবে