ঋণ
ঋণগ্রস্তের দায়িত্বে অবশ্য প্রদেয় সম্পদ
যদি ব্যক্তির দায়িত্বে এমন ঋণ থাকে যা নিসাবের সমান অথবা নিসাব থেকে কিছু কম, তাহলে তাতে যাকাত ফরজ হবে না। আর যদি ঋণ এমন হয় যা নিসাবকে কমিয়ে দেয় না, তাহলে ঋণের পরিমাণ সম্পদ হিসাব থেকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সম্পদের যাকাত দিতে হবে।
উদাহরণত: যদি কোনো ব্যক্তির কাছে ১০০০০ ডলার থাকে, আর তার ঋণের পরিমাণ হয় ১০০০০ ডলার তাহলে তাতে যাকাত ফরজ হবে না। তদ্রুপভাবে যদি ঋণের পরিমাণ হয় ৯৯৫০ ডলার, তাহলেও তা নিসাবকে কমিয়ে দিচ্ছে, অতঃপর এ অবস্থায়ও যাকাত ফরজ হবে না। পক্ষান্তরে যদি ঋণের পরিমাণ হয় ৬০০০ ডলার, তবে যাকাত ফরজ হবে।
১- যদি যাকাতদাতার অন্যকে ধার-দেয়া টাকা ফিরিয়ে আনা দুষ্কর হয়, যেমন ধারগ্রহীতা নিঃ-দরিদ্র অথবা ধার নেয়ার বিষয়টি সে অীকার করে বসে, এমতাবস্থায় ঋণদাতাকে, যে বছরগোলোতে ঋণ উসুল করতে ব্যর্থ হবে, সে বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না। বরং যে বছর তা আদায় করতে সক্ষম হবে কেবল সে বছরের যাকাত আদায় করলেই চলবে।
২- যদি ধার-দেয়া টাকা ফিরিয়ে আনা দুষ্কর না হয়, যেমন ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে কালক্ষেপ করে না। বরং সে পরিশোধের ইচ্ছা রাখে, এমতাবস্থায় যাকাতদানকারীকে প্রতি বছরের জন্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে; কেননা উল্লিখিত পরিস্থিতিতে ধার-দেয়া সম্পদ যাকাতদাতার কাছেই রয়ে গেছে বলে মনে করা হবে।
বন্ড
এমন একটি সনদ যা ইস্যুকারী এর বাহককে এর গায়ে লেখা মূল্য প্রদান করতে বাধ্য থাকে যখন সে তার হকদার হয়। সাথে সাথে বন্ডের মূল্যের সাথে, চুক্তি মোতাবেক, অতিরিক্ত লাভও প্রদান করা হয়।
এটি পরিস্কার সুদ ও হারাম। সে হিসেবে সাধারণভাবে লেনদেনকৃত বন্ড অবৈধ; কেননা তা এমন একটি ধার, যার সাথে সরাসরি লাভযুক্ত রয়েছে। যারা এ ধরনের লেনদেনের সাথে যুক্ত রয়েছে তাদের উচিত আল্লাহর কাছে তাওবা করা।
বন্ডের যাকাত
বন্ডের যাকাতের হুকুম ঋণের যাকাতের মতোই। অতঃপর এতে যাকাত ফরজ হবে যদি তা নিসাব পরিমাণ হয়। অথবা বন্ডধারী ব্যক্তির অন্যান্য সম্পদ, যেমন টাকা-পয়সা, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি একসাথে মিলে যদি নিসাব পরিমাণ হয় এবং একবছর অতিক্রান্ত হয়, তাহলে তাতে যাকাত ফরজ হবে এবং ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। আর যদি বন্ড এমন হয় যা সুনির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ভাঙ্গানো যাবে না, এমতাবস্থায়ও যাকাত রহিত হবে না, বরং যখন ভাঙ্গানো যাবে তখন বিগত সকল বছরের যাকাত প্রদান আবশ্যক হবে।
চাকরি শেষে প্রাপ্য ভাতা
চাকরির পূর্ণ মেয়াদ শেষে চাকরিজীবীকে প্রদত্ত বেতনভিত্তিক কল্যাণমূলক ভাতা, যা সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্ট শর্তের বর্তমানে- নীতিমালা অনুযায়ী- প্রদান করে থাকে।
অবসর ভাতা
অবসর ভাতা
সুনির্দিষ্ট অংকের টাকা, যা কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান, স্যোসাল ইনসিউরেন্স নীতিমালার আওতাধীন, কোনো চাকরিজীবীকে প্রদান করে থাকে পেনশন বেতনপ্রাপ্তির শর্তাবলি অপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও।
পেনশন বেতন
একজন সরকারী অথবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো চাকরিজীবী চাকরির পূর্ণ মেয়াদ শেষে নীমিমালা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট শর্তের উপস্থিতিতে যে বেতন পেয়ে থাকে সেটাকেই পেনশন বেতন বলে।
এগুলোর হুকুম হলো, চাকরিজীবী যতদিন চাকরিরত থাকবে তাকে কোনো যাকাত দিতে হবে না; কেননা এ প্রকৃতির অর্থে ব্যক্তির পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত নয়। আর অর্থসম্পদ ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মালিকানাধীন থাকা যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত। পূর্ণ মালিকানা না থাকার দলিল, চাকরিরত ব্যক্তি ইচ্ছা করলেই তা ব্যয় করতে পারে না। বরং চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত মালিকানাসুলভ কোনো অধিকারই তাতে খাটাতে পারে না।
উল্লিখিত বেতন-ভাতাদি সুনির্দিষ্টকরণ ও চাকরিজীবীকে প্রদানের ব্যাপারে যখন সিদ্ধান্ত হবে এবং তাকে একসাথে অথবা বিভিন্ন মেয়াদে তা দেয়া হবে তখন এতে পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যে পরিমাণ হস্তগত হবে, নিসাব পূরণ হওয়ার শর্তে তা থেকে যাকাত দিতে হবে।
সিকিউরিটি
ভাড়াদাতাকে ভাড়াটিয়া ব্যক্তির অগ্রিম প্রদত্ত টাকা
ভাড়াটিয়া ব্যক্তিকে এ জাতীয় টাকার যাকাত প্রদান করতে হবে না; কেননা এতে পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত নয়, যা যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত।(ড. সালাহ আস্সাওয়ী, আধুনিক ফিক্হী বিষয়, পৃ:৬০)
স্বত্বাধিকার
অজড় কোনো কিছুর উপর ব্যক্তির অধিকারস্বত্ব, হতে পারে তা ব্যক্তির মেধাজাত কোনো বিষয়, যেমন লেখকস্বত্ব, আবিষ্কারস্বত্ব অথবা ব্যবসায়িক কোনো কার্যক্রম যা গ্রাহক সংগ্রহের উদ্দেশে ব্যবসায়ী ব্যক্তি গ্রহণ করে থাকেন, যেমন ট্রেইড নেইম, ট্রেইড মার্ক ইত্যাদি।
রেওয়াজ অনুযায়ী স্বত্বাধিকারের একটি আর্থিক মূল্য রয়েছে, যা ইসলামি শরীয়ার দৃষ্টিতেও কার্যকর। অতএব ইসলামি শরীয়ার বিধান মোতাবেক তা ব্যবহারে আনা বৈধ। আর এ অধিকার সংরক্ষিত, কারো পক্ষেই তা লংঘন করা জায়েয নয়।
অবশ্য মূল লেখকস্বত্বা অথবা আবিষ্কার স্বত্বায় যাকাত নেই; কেননা তাতে যাকাতের শর্ত অনুপস্থিত, তবে যদি স্বত্বাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থ হস্তগত হয় তবে উপকারসাধনযোগ্য সম্পদের ন্যায় তার যাকাত প্রদান ফরজ হবে।(ড. সালাহ আস্সাওয়ী, আধুনিক ফিক্হী বিষয়, পৃ:৬০)
মজুরি ও বেতন
কাজের বিনিময়ে কর্মীব্যক্তি যে অর্থ পেয়ে থাকে
এর হুকুম সোনা-রুপার যাকাতের মতোই। অর্থাৎ যখন নিসাব পরিমাণ হবে ও এক বছর অতিক্রান্ত হবে তখন তাতে যাকাত ফরজ হবে। আর তাতে যাকাতের পরিমাণ হলো ২.৫%.
হারাম মাল
যে সম্পদ অর্জন করা অথবা যে সম্পদ থেকে উপকার লাভ শরীয়তে নিষিদ্ধ তাই হলো হারাম মাল, যেমন মদের ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ অথবা সুদ বা চুরিকৃত সম্পত্তি ইত্যাদি।
যে সম্পদ মূলে হারাম - যেমন মদ অথবা শূকর- ইত্যাদির ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থে যাকাত নেই। তদ্রূপভাবে যে সম্পদ মূলে হারাম নয়, তবে অন্যকোনো কারণে, শরীয়তের বিধান বিগ্নিত হওয়ার দরুন হারাম হয়েছে, যেমন চুরিকৃত সম্পদ, এরূপ সম্পদেও যাকাত নেই; কেননা এ ধরনের সম্পদে ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মালিকানা প্রতিষ্টিত হয় না, যা যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত।
ক. উপার্জন-পদ্ধতিতে সমস্যা থাকায় এ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি কখনো তার মালিক হবে না, সময় যতোই গড়িয়ে যাক না কেন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর আবশ্যক হবে মূল মালিক অথবা তার উত্তারাধিকারীকে - যদি জানা থাকে - সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া। আর যদি মূল মালিক অথবা তার উত্তারাধিকারীকে চেনার বিষয়ে ব্যক্তি নিরাশ হয়ে পড়ে, তবে হারাম মাল থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে সদকা হিসেবে কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় করে দিতে হবে।
খ. যদি হারাম কাজের মজুরি হিসেবে সম্পদ অর্জন করে থাকে তাহলে অর্জনকারী তা কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে দেবে। যার কাছ থেকে তা নিয়েছে তাকে ফেরত দেবে না; কেননা সে তা আবারও গুনাহের কাজে ব্যয় করবে।
গ. যার কাছ থেকে হারাম মাল নেয়া হয়েছে সে যদি অবৈধ লেনদেন পরিত্যাগ না করার ব্যাপারে অনড় থাকে, যা তার সম্পদ হারাম হওয়ার কারণ হয়েছে, যেমন সূদী লেনেদেনের টাকা, তাহলে তার সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, বরং তা কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা হবে।
ঘ. যদি হারাম মাল হস্তগতকারী ব্যক্তি মূল হারাম মাল ফিরিয়ে দিতে অপারগ হয়, তাহলে তার স্থলে সমপরিমাণ মাল অথবা তার মূল্য মালিককে ফিরিয়ে দেবে, যদি তাকে খুঁজে বের করতে পারে, অন্যথায় সমপরিমান মাল বা তার মূল্য, মূল মালিকের পক্ষ থেকে সদকা করার নিয়তে কল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করে দেবে।(ড. সালাহ আস্সাওয়ী, আধুনিক ফিক্হী বিষয়, পৃ:৬১ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ)