গোসলের আভিধানিক অর্থ
কোনো কিছুর ওপর পানি পূর্ণাঙ্গরূপে বাইয়ে দেয়া।
শরয়ী পরিভাষায় গোসলের অর্থ
আল্লাহ তাআলার ইবাদতের উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গরূপে শরীর ধৌত করা।
বীর্য হলো: গাড়-সাদা পানি যা যৌন-উত্তেজনাসহ ঠিকরে বের হয়, যারপর শরীর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বীর্য গন্ধে অনেকটা পঁচা ডিমের মতো। ইরশাদ হয়েছে :
( وَإِن كُنتُمۡ جُنُبٗا فَٱطَّهَّرُواْۚ ) (আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও) [ সূরা আল মায়েদা:৬] আলী রাযি. বলেছেন, ‘তুমি যদি সজোরে পানি নির্গত করো, তবে গোসল করো।’
(বর্ণনায় আবু দাউদ)
১- যদি কারো স্বপ্নদোষ হয় আর বীর্যপাত না ঘটে, তবে গোসল ফরজ হবে না। যদি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর বীর্যপাত ঘটে তবে গোসল ফরজ হবে।
২- কেউ যদি বীর্য দেখতে পায় আর স্বপ্নদোষের কথা মনে না থাকে, তবে গোসল ফরজ হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘পানি তো পানির জন্য’(বর্ণনায় মুসলিম) অর্থাৎ বীর্যপাত হলে গোসল ফরজ হবে’।
৩- যদি পুরষাঙ্গে বীর্যের স্থানান্তর অনুভূত হয়, আর বীর্য বের না হয় তবে গোসল ফরজ হবে না।
৪- যদি কারো অসুস্থতার কারণে উত্তেজনা ব্যতীত বীর্যপাত ঘটে তবে গোসল ফরজ হবে না।
৫- যদি গোসল ফরজ হওয়ার পর গোসল করে নেয় এবং গোসলের পর বীর্য বের হয়, তাহলে পুনরায় গোসল করতে হবে না। কেননা এ সময় সাধারণত উত্তেজনা ব্যতীত বীর্য নির্গত হয়। এ অবস্থায় সতর্কতার জন্য অজু করে নেয়াই যথেষ্ট হবে।
৬- যদি ঘুম থেকে জাগার পর আদ্রতা দেখা যায়, এবং কারণ মনে না থাকে, তবে এর তিন অবস্থা হতে পারে:
ক - আদ্রতা যে বীর্য থেকে নয় এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হলে গোসল ফরজ হবে না। বরং এ আদ্রতার হুকুম হবে পেশাবের ন্যায়।
খ- বীর্য কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হলে যাচাই করে দেখতে হবে। যদি এমন বিষয় মনে করা সম্ভব হয় যা উক্ত আদ্রতা বীর্য থেকে হওয়ার সম্ভাবনাকে পোক্ত করে দেয়, তবে তা বীর্য বলেই গণ্য হবে। আর যদি এমন বিষয় মনে করা সম্ভব হয় যা উক্ত আদ্রতা যে মযী তার সম্ভাবনাকে পোক্ত করে দেয়, তবে তা মযী বলেই গণ্য হবে।
গ - আর যদি কোনো কিছুই মনে করতে না পারা যায়, তাহলে সতর্কতার জন্য গোসল করা জরুরি।
৭- যদি বীর্য দেখা যায় কিন্তু কখন স্বপ্নদোষ হয়েছে তা মনে না থাকে, তাহলে গোসল করতে হবে এবং সর্বশেষ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর যত নামাজ আদায় করা হয়েছে তা পুনরায় পড়তে হবে।
পুরষাঙ্গ ও যোনির সম্মিলনকে সঙ্গম বলে। আর এটা ঘটে পুরষাঙ্গের পুরো অগ্রভাগ যোনির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার ফলে। এতটুকু হলেই সঙ্গম বলে ধরা হবে এবং বীর্যপাত না ঘটলেও গোসল ফরজ হয়ে যাবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘নারী ও পুরুষের গুপ্তাঙ্গের সম্মিলন ঘটলেই গোসল ফরজ হয়ে যাবে।’(বর্ণনায় তিরমিযী)
এর প্রমাণ কায়েস ইবনে আসেম যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গোসল করার নির্দেশ দেন।(বর্ণনায় আবু দাউদ)
আয়েশা রাযি. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতিমা বিনতে আবি হুবাইশ রাযি. কে বলেন, ‘হায়েয এলে নামাজ ছেড়ে দাও, আর হায়েয চলে গেলে গোসল করো ও নামাজ পড়ো।’ নিফাস হলো হায়েয এর মতো, এ ব্যাপারে কারো দ্বীমত নেই।(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা যায়নাব রাযি. এর মৃত্যুর পর তিনি বলেছেন, ‘তাকে তিনবার গোসল দাও, অথবা পাঁচবার অথবা তারও বেশি যদি তোমরা ভালো মনে করো।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
গোসলের ক্ষেত্রে ফরজ হলো গোসলের নিয়তে সমস্ত শরীর পানি দিয়ে ধোয়া। তা যেভাবেই হোক না কেন। তবে মুস্তাহাব হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোসলের অনুসরণ করা। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাবত থেকে গোসলের জন্য পানি রাখলেন। অতঃপর তিনি ডান হাত দিয়ে বাম হাতে দুই অথবা তিনবার পানি ঢাললেন। এরপর তিনি তাঁর গুপ্তাঙ্গ ধৌত করলেন। এরপর তিনি জমিনে অথবা দেয়ালে দুই অথবা তিনবার হাত মারলেন। অতঃপর তিনি কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। তিনি তাঁর চেহারা ও দুই বাহু ধৌত করলেন। এরপর তিনি মাথায় পানি ঢাললেন। শরীর ধৌত করলেন। তিনি তাঁর জায়গা থেকে সরে গেলেন এবং দু’পা ধৌত করলেন। বর্ণনাকারী বলেন,‘এরপর আমি একটি কাপড়ের টুকরা নিয়ে এলাম। অবশ্য তিনি তা চাইলেন না। তিনি তাঁর হাত দিয়েই পানি ঝেড়ে ফেলতে শুরু করলেন।’(বর্ণনায় বুখারী)
সে হিসেবে গোসল করার পদ্ধতি হলো:
১- দুই অথবা তিনবার কব্জি পর্যন্ত দু’হাত ধোয়া।
২- গুপ্তাঙ্গ ধোয়া।
৩- জমিন অথবা দেয়ালে দুই অথবা তিনবার হাত মারা।
৪- নামাজের অজুর ন্যায় অজু করা, তবে মাথা মাসেহ ও পা ধোয়া ব্যতীত।
৫- মাথায় পানি ঢালা।
৬- সমস্ত শরীর ধোয়া।
৭- যেখানে দাঁড়িয়ে গোসল করা হয়েছে সেখান থেকে সরে গিয়ে পা ধোয়া ।
দলিল, আল-কুরআনের আয়াত:
(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمۡ سُكَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعۡلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغۡتَسِلُواْۚ )
{হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর, তবে যদি তোমরা পথ অতিক্রমকারী হও।} [আন-নিসা:৪৩]
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বায়তুল্লাহর তাওয়াফ হলো নামাজতুল্য’।
(বর্ণনায় নাসায়ী)
এর দলিল, আল কুরআনের আয়াত,
(لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ) {কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া।}[সূরা আল ওয়াকিয়া:৭৯], হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পবিত্রতা ব্যতীত কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না’।(হাদীসটি ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।)
আলী রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইস্তেন্জা সেরে বের হয়ে আসতেন, তিনি আমাদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন, আমাদের সাথে গোশত খেতেন, জানাবত ব্যতীত কোনো কিছু তাঁকে কুরআন থেকে বারণ করত না’।
(বর্ণনায় তিরমিযী)
ইরশাদ হয়েছে:
(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمۡ سُكَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعۡلَمُواْ مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغۡتَسِلُواْۚ)
{হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না, যতক্ষণ না তোমরা গোসল কর।}
[সূরা আন-নিসা:৪৩]
১- জুমার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, {‘যে ব্যক্তি জুমার জন্য অজু করল সে এর দ্বারাই নেয়ামত পেয়ে গেল, আর যে ব্যক্তি গোসল করল, তবে গোসলই উত্তম।’}[বর্ণনায় আবু দাউদ]
২- হজ্ব ও উমরার জন্য গোসল করা। যায়েদ ইবনে ছাবেত রাযি. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইহরামের উদ্দেশে কাপড় পরিত্যাগ করতে ও গোসল করতে দেখেছেন।’ (বর্ণনায় তিরমিযী)
৩- মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর গোসল করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাল সে যেন গোসল করে।’(বর্ণনায় ইবনে মাজাহ)
৪- প্রতিবার সঙ্গমের পর গোসল করা। আবু রাফে রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের কাছে গমন করলেন, এবং প্রত্যেকের কাছেই গোসল করলেন। বর্ণনাকারী বলেন,‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, একবার গোসল করলেই কি হয় না? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এটাই উত্তম, অধিক ভালো ও পবিত্রতা’।(বর্ণনায় আবু দাউদ)
যা উচিত নয়১- জানাবতের গোসল এতটুকু দেরিতে করা যে নামাজের ওয়াক্ত চলে যায়।
২- নারীর মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পর পরবর্তী ফরজ নামাজ ছেড়ে দেয়া। যদি কোনো নারী যোহরের নামাজের শেষ ওয়াক্তে পবিত্র হয় এবং এক রাকাত পড়া যাবে এমন সময় বাকী থাকে তবে তার ওপর যোহরের নামাজ ফরজ বলে গণ্য হবে এবং গোসল করে যোহরের নামাজ পড়তে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এক রাকাত নামাজ পেল সে ফজরের নামাজ পেল। আর যে ব্যক্তি সুর্যাস্তের পূর্বে এক রাকাত আসরের নামাজ পেল সে আসরের নামাজ পেল’।
(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)