সোনা-রুপার যাকাত

34940

 

সোনা-রুপা

সোনা-রুপা এবং যা কিছু এর স্থলাভিষিক্ত, যেমন বর্তমানযুগে প্রচলিত কাগুজে টাকা।

সোনা-রুপার যাকাতের হুকুম

সোনা-রুপার যাকাত দেয়া ফরজ; ইরশাদ হয়েছে:

(وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ ) [التوبة:34]

{এবং যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।} [সূরা তাওবা:৩৪]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘সোনা-রুপার মালিক যদি এ সবের হক আদায় না করে, তবে তা দিয়ে কিয়ামতের দিন আগুনের পাত তৈরি করা হবে, অতঃপর তা আগুনে গরম করা হবে এবং তা দিয়ে তার পার্শ্বদেশে, কপালে ও পিঠে ছেঁকা দেয়া হবে। পাত ঠান্ডা হয়ে গেলে আবারও তা গরম করে আনা হবে। আর এটা হবে এমন এক দিনে, যা হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের পরিমাণ দীর্ঘ। বান্দাদের মাঝে শেষ ফয়সালা হওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। ফয়সালা শেষ হলে তাদের একদলকে জান্নাতের ও অপর দলকে জাহান্নামের পথ দেখিয়ে দেয়া হবে।’ (বর্ণনায় মুসলিম)

সোনা-রুপার ওপর যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী

১ -এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া

২ - পূর্ণ মালিকানা

৩ - নিসাব পূর্তি

সোনা-রুপার নিসাব

১ - সোনার নিসাব বিশ দিনার তথা (৮৫) গ্রাম। একদিনার পরিমাণ = ৪.২৫ গ্রাম। অতএব যাকাতের নিসাব হবে: ৪.২৫*২০=৮৫ গ্রাম নিরেট সোনা।

রুপার নিসাব হলো দু’শ দিরহাম অর্থাৎ (৫৯৫) গ্রাম। রুপার এক দিরহামের পরিমাণ হলো ২.৯৭৫ গ্রাম, তাই রুপার নিসাব হবে ২.৯৭৫*২০০= ৫৯৫ গ্রাম নিরেট রুপা।

৩ -টাকাকড়ির যাকাত আদায়ের মুহুর্তে, সোনা অথবা রুপার মূল্যের ভিত্তিতে নির্ণয় করতে হবে। যদি টাকাকড়ি এ দুটির যেকোনো একটির নিসাবের সমান হয় তাহলে যাকাত ফরজ হবে।

উদাহরণত: যদি এক গ্রাম সোনার মূল্য ৩০ ডলার হয়, এবং কোনো ব্যক্তির কাছে অবশ্য প্রয়োজনীয় খরচের বাইরে (৮৫*৩০=২৫৫০) দু হাজার পাঁচশ পঞ্চাশ ডলার জমা থাকে এবং এর ওপর এক বছর অতিক্রান্ত হয়, তবে তাতে যাকাত ফরজ হবে।

সোন-রুপায় যাকাতের পরিমাণ

সোনা-রুপা ও টাকাকড়িতে ফরজ হওয়া যাকাতের পরিমাণ হলো রুবউল উশর অর্থাৎ (২.৫%)। সে হিসেবে প্রতি বিশ দিনারে যাকাত হবে অর্ধ দিনার। আর যা এর অতিরিক্ত হবে, তা কম হোক বা বেশি হোক, এ অনুপাতেই হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।

রুপার ক্ষেত্রে প্রতি দু’শ দিরহামে পাঁচ দিরহাম যাকাত হিসেবে বের করতে হবে। আর যা এর অতিরিক্ত হবে তা এ অনুপাতে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। এর প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী, ‘যদি তুমি দু’শ দিরহামের মালিক হও এবং এর উপর এক বছর পার হয়ে যায়, তবে তাতে পাঁচ দিরহাম দিতে হবে। আর সোনার ক্ষেত্রে যতক্ষণ তুমি বিশ দিনারের মালিক না হবে তোমাকে কিছু দিতে হবে না। তাই যখন তোমার কাছে বিশ দিনার হয়ে যাবে এবং এর ওপর এক বছর অতিক্রান্ত হবে তাতে অর্ধ দিনার যাকাত দিতে হবে। আর যা এর অতিরিক্ত হবে, তা সে অনুপাতে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।’ [বর্ণনায় আবু দাউদ]

একটি প্রায়োগিক উদাহরণ

এক ব্যক্তির কাছে (৯০০০) নয় হাজার ডলার রয়েছে এবং তা তার মালিকানায় থাকাবস্থায় এক বছর পার হয়েছে। এমতাবস্থায় কি তার উপর যাকাত ফরজ হবে?

এ ক্ষেত্রে প্রথমে আমরা সোনা অথবা রুপার আলোকে নিসাব হিসাব করব। আর তা হবে নিম্নরূপ:

নিসাব : পঁচাশি গ্রাম নিরেট সোনা

= ৮৫* যাকাত ফরজ হওয়ার দিন এক গ্রাম সোনার মূল্য। ধরে নিলাম যে তা ৩০ ডলার।

= ৮৫*৩০= ২৫৫০ ডলার।

তাহলে নিসাব হলো ২৫৫০ ডলার। অতএব উল্লিখিত ব্যক্তির সম্পদ নেসাব পরিমাণ হয়েছে এবং এর ওপর এক বছর অতিক্রান্তও হয়েছে। অতঃপর তার ওপর যাকাত ফরজ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: প্রদেয় যাকাতের পরিমাণ বের করব নিম্নবর্ণিতভাবে:

প্রদেয় যাকাতের পরিমাণ : ২.৫%

=৯০০০*২.৫স্ট১০০ = ২৫৫ ডলার.

তাহলে উল্লিখিত ব্যক্তির সম্পদে প্রদেয় যাকাতের পরিমাণ হলো ২৫৫ ডলার।

অলংকারের যাকাত

অলংকার দু’প্রকার: সোনা-রুপার অলংকার। সোনা-রুপা ব্যতীত অন্যকোনো ধাতুর অলংকার।

১- সোনা-রুপার অলংকার

প্রথম প্রকার: সঞ্চয় ও সংরক্ষণের জন্য তৈরিকৃত অলংকার অথবা এমন অলংকার যা ব্যবসার উদ্দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ধরনের অলংকারে যাকাত দিতে হবে।

ব্যবহারের জন্য তৈরিকৃত অলংকার। এ প্রকৃতির অলংকারেও জিম্মাদারি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যাকাত প্রদান করা উত্তম। জনৈক নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন। সাথে ছিল তার মেয়ে। মেয়ের হাতে সোনার দুটি পুরো চুড়ি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন,‘তুমি কি এর যাকাত দাও? সে বলল,‘না।’ তিনি বললেন,‘তোমার কি ভালো লাগবে, যদি আল্লাহ তাআলা এ দুটির পরিবর্তে পরকালে তোমাকে দুটি আগুনের চুড়ি পরিয়ে দেন?’ বর্ণনাকারী বলেন ‘অতঃপর মেয়েটি চুড়ি দুটি খুলে ফেলল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সোপর্দ করল ও বলল,‘এ দুটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য।’ (বর্ণনায় আবু দাউদ)

আলেমদের কেউ কেউ অলংকারে যাকাত নেই বলে মন্তব্য করেছেন; তাদের যুক্তি অলংকার এমন সম্পদ নয় যা (লাভের আশায়) পরিবর্ধিত করার জন্য সংরক্ষণ করা হয়। বরং তা কেবল ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রাখা হয়, পোশাক, ফার্নিচার ও ঘরের আসবাপত্রের মতোই। উপরন্তু অলংকার হলো সৌন্দর্য অর্জনার্থে নারীর প্রয়োজনীয় বিষয়। আর যাকাতের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় হলো সম্পদের বর্ধনশীলতা, যা যাকাত প্রয়োগের জন্য জরুরি।

তবে সতর্কতার দাবি হলো সৌন্দর্যলাভ ও বৈধ ব্যবহারের জন্য তৈরিকৃত অলংকারের যাকাত দেয়া। যাকাতের জিম্মাদারি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এটাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যাতে তোমার সন্দেহ লাগে তা পরিত্যাগ করে যা তোমার কাছে নিঃসন্দেহ মনে হয় তা ধরো।’(বর্ণনায় বুখারী)

২- সোনা-রুপা ব্যতীত অন্যকোনো অলংকারে যাকাত

যেমন ব্রোঞ্জ, মতি-মুক্তা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যাকাত প্রযোজ্য হবে না, এসবের মূল্য যতোই হোক না কেন। তবে যদি ব্যবসায়িক উদ্দেশে ব্যবহৃত হয় তাহলে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে তাতে যাকাত আরোপিত হবে।