রমজানের রোজা

13658

 

রমজানের রোজা

রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর ফরজ করে দেওয়া একটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন :

(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ )

{হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।} [সূরা আল বাকারা:১৮৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,‘ইসলাম পাঁচটি বিষয়ের ওপর নির্মিত হয়েছে’ এ-পাঁচটির মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন( রমজানের রোজা)

রমজানের ফজিলত

১ - রমজান মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে শয়তানকে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং মানুষের হৃদয়ে ভালো কাজ করার প্রেরণা জাগ্রত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন রমজান প্রবেশ করে আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানদেরকে শিকল পরিয়ে দেয়া হয়।’

(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

২- ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম-কিয়াম চর্চা করে আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোজা রাখে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

অন্যএক হাদীসে এসেছে,‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রমজানের রাতযাপন করে আল্লাহ তাআলা তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৩- মাহে রমজানে লায়লাতুল কদর রয়েছে, যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

(لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣)

{লায়লাতুল কদর এক হাজার মাস থেকে উত্তম।} [ সূরা আল কাদ্র: ৩]

আর যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লায়লাতুল কদর যাপন করবে তার অতীতের গুনাহসমূহ আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লায়লাতুল কদর যাপন করল আল্লাহ তাআলা তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দিলেন।’(বর্ণনায় মুসলিম)

৫- রমজান মাস কুরআনের মাস। এ মাসেই নাযিল হয়েছে মহিমান্বিত কুরআন। তাই এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

(شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ )

{রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়েত স্বরূপ এবং হিদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।} [ সূরা আল বাকারা:১৮৫]

৬ - রমজান মাস সদকা ও দানখয়রাতের মাস, ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবথেকে বেশি দানশীল ছিলেন, আর তিনি মাহে রমজানে সমধিক দানশীল হতেন যখন জিব্রীল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর জিব্রীল রমজানের প্রতি রাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁকে কুরআন চর্চা করাতেন। যখন জিব্রীল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি দান-খয়রাতে উন্মুক্ত বাতাস থেকেও অধিক বেগবান হতেন।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

রমজানে রোজা ভঙ্গ করা

রমজানে রোজা ভঙ্গ করা হারাম ও বড় গুনাহ। আর যে ব্যক্তি ওযর ব্যতীত রমজানের কোনো একদিনের রোজা ভেঙ্গে ফেলল এবং তাওবা করল না, সারা জীবনের রোজাও এ দিনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যথেষ্ট হবে না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি রমজানের কোনো একদিন, আল্লাহ তাআলার দেয়া সুযোগ ব্যতীত রোজা ভঙ্গ করল, আজীবনের রোজাও তার কাযা হিসেবে যথেষ্ট হবে না।’(বর্ণনায় আবু দাউদ) আর রোজা ভঙ্গের শাস্তিও অনেক কঠিন। আবু উমামা আল-বাহেলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,‘আমি ঘুমন্ত ছিলাম, এ সময় দু’ব্যক্তি এলেন..... অতঃপর আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। পরবর্তীতে আমি কিছু লোক দেখতে পেলাম যাদেরকে পায়ের রগে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যাদের মুখের চোয়াল ছিল ফাঁটা যাত্থেকে রক্ত ঝরছিল। তিনি বললেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা করা?’ তিনি বললেন,‘ওরা হলো যারা রোজা ভঙ্গের সময় আসার পূর্বেই রোজা ভঙ্গ করত।’
(বর্ণনায় ইবনে হিব্বান)

রমজান শুরু হয়েছে তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে?

রমজান শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে চাঁদ দেখার মাধ্যমে। যদি শাবান মাসের ঊনত্রিশ তারিখের সূর্যাস্তের পর চাঁদ দেখা যায় তাহলে এটাই হবে রমজান শুরুর নিশ্চিত দলিল। আর যদি এ দিন চাঁদ দেখা না যায় অথবা মেঘ, ধুলো অথবা ধোঁয়া ইত্যাদি চাঁদ দেখাকে বাধাগ্রস্ত করে, তবে শাবান মাস ত্রিশদিন পূর্ণ করতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ভঙ্গ করো। আর যদি এ মাসের চাঁদ দেখা সম্ভব না হয় তবে শাবান মাস ত্রিশদিন হিসাব করো।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

রোজা ভঙ্গের ওযরসমূহ

১ - অসুস্থতা

অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :

(فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ)

{(আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।} [সূরা আল বাকারা:১৮৪]

যে অসুস্থতার কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা চলে তা হলো এমন অসুস্থতা যার কারণে রোজা রাখা অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় অথবা রোজা রাখলে নিশ্চিত ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

অসুস্থ ব্যক্তির রোজা ভঙ্গ করা

যদি অসুস্থ ব্যক্তি রোজা ভঙ্গ করে আর তার অসুস্থতা এমন হয় যা সুস্থ হবে বলে আশা থাকে, তাহলে সুস্থ হওয়ার পর যেসব রোজা ছুটে গেছে তা কাযা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

(فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ)

{আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।} [সূরা আল বাকারা:১৮৪]

যে রোগ ভালো হওয়ার আশা নেই - যেমন জীবনব্যাপী অসুস্থতা অথবা এমন বার্ধাক্য

যার কারণে ব্যক্তি স্থায়ীভাবে রোজা রাখতে অপারগ হয়ে যায় - এমতাবস্থায় প্রতিদিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে অর্ধ সা’ চাউল অথবা অন্যকোনো দেশীয় খাবার দান করতে হবে।

২- সফর

মুসাফির ব্যক্তির জন্য রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ। তবে ভাঙ্গা রোজাগুলো পরবর্তীতে অবশ্যই কাযা করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:

(فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ)

{আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।} [সূরা আল বাকারা:১৮৪]

যে সফরে রোজা ভঙ্গ করা চলে তা হলো একই ধরনের সফর যার কারণে নামাজ কসর করা চলে।

কিন্তু যদি মুসাফির ব্যক্তি রোজা রাখে তবে তার রোজা শুদ্ধ হবে। আনাস ইবনে মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সফর করতাম। যে ব্যক্তি রোজা রাখত তাকেও তিনি দোষারোপ করতেন না, আবার যে রোজা রাখত না তাকেও দোষারোপ করতেন না।’(বর্ণনায় বুখারী)

তবে শর্ত হলো রোজা যেন মুসাফিরের জন্য খুব কষ্টকর না হয়। আর যদি রোজা রাখা খুব কষ্টকর হয় অথবা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে রোজা ভঙ্গ করাই উত্তম হবে; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরাবস্থায় এক রোজাদার ব্যক্তিকে দেখলেন যে প্রচন্ড গরমের কারণে তাকে ছায়া দেয়া হচ্ছে এবং লোকজন তার চারপাশে ভিড় করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সফর অবস্থায় রোজা রাখা উত্তম কাজের মধ্যে শামিল নয়।’
(বর্ণনায় বুখারী)

৩- গর্ভ ও দুগ্ধদান

গর্ভাবস্থা অথবা দুগ্ধদান অবস্থায় নারী যদি তার ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা বৈধ হবে। তবে তাকে কাযা করতে হবে অসুস্থ ব্যক্তির মতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুসাফির ব্যক্তির উপর থেকে রোজা এবং নামাজের একাংশ উঠিয়ে নিয়েছেন। আর গর্ভধারী ও দুগ্ধদানকারী নারীর ওপর থেকে তিনি রোজা উঠিয়ে নিয়েছেন।’
(বর্ণনায় তিরমিযী)

আর যদি নিজের ক্ষতির কোনো ভয় না থাকে, কিন্তু বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলেও রোজা ভঙ্গ করা বৈধ হবে, তবে তাকে কাযা করতে হবে ও প্রতিদিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করতে হবে। ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন,‘দুগ্ধদানকারী ও গর্ভধারী নারী যদি তার সন্তানের ব্যাপারে আশঙ্কা করে তাহলে সে রোজা ভঙ্গ করবে ও মিসকীনকে খাদ্যদান করবে।’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

৪- হায়েয ও নিফাস

যে নারী হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত হয়েছে সে আবশ্যিকভাবে রোজা ভঙ্গ করবে। এ অবস্থায় রোজা রাখা হারাম হবে। এমতাবস্থায় রোজা রাখলে তা শুদ্ধ হবে না। তবে ভাঙ্গা রোজাগুলো পরবর্তীতে কাযা করতে হবে। এর প্রমাণ, আয়েশা রাযি.-কে হায়েযগ্রস্ত নারী রোজা কাযা করবে কি না, এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,‘বিষয়টি আমাদেরকেও স্পর্শ করত, অতঃপর আমাদেরকে রোজা কাযা করার নির্দেশ দেয়া হত তবে নামাজ কাযা করার নির্দেশ দেয়া হত না।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)