ইহরাম

17001

 

আভিধানিক অর্থে ইহরাম

বারণ করা।

শরয়ী অর্থে ইহরাম

হজ্বের একটি আমলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে হজ্বকর্মে প্রবেশের নিয়ত করা

হজ্বের একটি আমলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে হজ্বকর্মে প্রবেশের নিয়ত করা

ইহরামের মুস্তাহাবসমূহ

১ - গোসল করা

খারেজা ইবনে যায়েদ ইবনে ছাবিত রাযি. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন «ে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছেন ইহরামের জন্য কাপড় পরিত্যাগ করতে ও গোসল করতে।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

২- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হবে বগল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার, গোফ ও নখ কর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে।

৩- আতর

আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,«আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইহরামের জন্য সুগন্ধি লাগাতাম যখন তিনি ইহরাম করতেন।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম) তবে তিনি তাঁর কাপড়ে সুগন্ধি লাগাতেন না; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,«তোমরা এমন কোনো কাপড় পরো না, যাকে জাআফরান অথবা র্ওস (একপ্রকার সুগন্ধিযুক্ত উদ্ভিদ যা আতর হিসেবে ব্যবহৃত হত) স্পর্শ করেছে|

- হজ্বে প্রবেশের নিয়তের পূর্বে পুরুষের ক্ষেত্রে সেলাই-করা কাপড় পরিত্যাগ করতে হবে এবং সেলাইবিহীন একটি লুঙ্গি ও চাদর এবং পায়ে স্যান্ডেল পরিধান করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,«তোমরা একটি (সেলাইবিহীন) লুঙ্গি ও একটি চাদর ও একজোড়া স্যান্ডেল পরিধান করবে। স্যান্ডেল না পাওয়া গেলে চামড়ার মোজা পরে নেবে এবং তা কেটে নেবে, যাতে তা টাখনু পর্যন্ত বনে যায়|»(বর্ণনায় আহমদ).

পক্ষান্তরে নারী যেকোনো পোশাকে ইহরাম বাঁধতে পারবে। নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো রঙ্গের পোশাক পরিধানের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নারীকে পুরুষের সাদৃশ্য অর্জন ও সৌন্দর্যখচিত পোশাক পরিহার করতে হবে। ইহরাম অবস্থায় নারী নেকাব ও হাতমোজাও পরিধান করবে না|

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ

১- এমন কোনো কাপড় দিয়ে পুরুষের মাথা ঢেকে রাখা যা মাথার সাথে লেগে থাকে

ইবনে উমর রাযি. বলেন, এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, মুহরিম কি পোশাক পরবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,«জামা পরিধান করো না, পাগড়ীও না, পাজামাও না, জামার উপরিভাগে প্রলম্বিত মাথা ঢাকার বস্ত্রও না।(বুরনুস)» (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

মৃত এক মুহরিম ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি বলেছেন: «তোমরা তার মাথা ঢেকো না; কেননা সে কেয়ামতের দিন তালবিয়ারত অবস্থায় উত্থিত হবে।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম))

আর যদি মাথার সাথে যুক্ত না থাকে, যেমন ছাতা, তাবু অথবা বাড়ি - গাড়ীর ছাদ তবে এতে কোনো সমস্যা হবে না।

২- পুরুষের ক্ষেত্রে সেলাই-করা পোশাক পরা

সেলাই করা পোশাক অর্থ এমন পোশাক যা মানুষের শরীরের মাপে অথবা কোনো অঙ্গের মাপে সেলাই করে তৈরি করা হয়েছে, যেমন স্বাভাবিক পরিধানের পোশাক, প্যান্ট-পাজামা, জামা, চামড়ার মোজা, কাপড়ের মোজা, হাত মোজা ইত্যাদি। এর দলিল উপরোল্লিখিত হাদীস: «জামা পরিধান করো না, পাগরিও না, পাজামাও না, জামার উপরিভাগে প্রলম্বিত মাথা ঢাকার বস্ত্রও না।»(বর্ণনায় বুখারী)

যদি ইহরামকারী সেলাইবিহীন লুঙ্গি না পায় তবে পাওয়ার আগ পর্যন্ত পাজামা পরিধান করতে পারবে। আর যদি স্যান্ডেল না পায়, তবে চামড়ার মোজা পরিধান করতে পারবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «তোমরা একটি (সেলাইবিহীন) লুঙ্গি ও একটি চাদর ও একজোড়া স্যান্ডেল পরিধান করবে। স্যান্ডেল না পাওয়া গেলে চামড়ার মোজা পরে নেবে এবং তা কেটে নেবে, যাতে তা টাখনু পর্যন্ত বনে যায়।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৩- স্থলজ শিকার-জন্তু হত্যা করা বা শিকার করা

আল্লাহ তাআলা বলেন :

(لَا تَقۡتُلُواْ ٱلصَّيۡدَ وَأَنتُمۡ حُرُمٞۚ )

{হে মুমিনগণ, ইহরামে থাকা অবস্থায় তোমরা শিকারকে হত্যা করো না} [সূরা আল মায়েদা:৯৫] অর্থাৎ তোমরা হজ্ব ও উমরার ইহরামরত অবস্থায় শিকার-জন্তু হত্যা করো না|

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন:

(وَحُرِّمَ عَلَيۡكُمۡ صَيۡدُ ٱلۡبَرِّ مَا دُمۡتُمۡ حُرُمٗاۗ )

{আর স্থলের শিকার তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাক।}
[সূরা আল মায়েদা:৯৬]

স্থলজ শিকারের অর্থ হালাল বন্যপ্রাণী অথবা পাখি।

অবশ্য পোষাপ্রাণী ও পাখি যেমন মুরগি, গবাদিপশু ইত্যাদি শিকার হিসেবে গণ্য নয়। তাই এগুলো মুহরিমের জন্য যবেহ করা বৈধ। সাগরের জীব-জন্তু শিকার করাও মুহরিমের জন্য বৈধ। আল্লাহ তাআলা বলেন:

(أُحِلَّ لَكُمۡ صَيۡدُ ٱلۡبَحۡرِ وَطَعَامُهُ)

{তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য।} [সূরা আল মায়েদা:৯৬]

আর যেসব জন্তু খাওয়া হারাম, যেমন সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি, সেগুলো হত্যা করা বৈধ। উপরন্তু মুহরিমের প্রতি যদি কোনো প্রাণী আক্রমণ চালায় তবে তাকেও হত্যা করা বৈধ|

৪-চুল মুণ্ডানো, কাটা অথবা উপড়ে ফেলাচুল মুণ্ডানো, কাটা অথবা উপড়ে ফেলা

আল্লাহ তাআলা বলেন:

(وَلَا تَحۡلِقُواْ رُءُوسَكُمۡ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡهَدۡيُ مَحِلَّهُۥ)

{অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে রাফাস ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।} [সূরা আল বাকারা:১৯৭] রাফাস শব্দের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন যে তা হলো জিমা বা সঙ্গম। আর এ বিষয়টি হলো ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের মধ্যে সমধিক কঠিন নিষিদ্ধ বিষয়।

৫- নখ কাটা

অর্থাৎ হাত পা উভয়টার নখ কাটা

৭-বিবাহের আক্দ করা

উসমান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: «মুহরিম ব্যক্তি বিবাহ করবে না, বিবাহ দেবেও না, এমনকি বিবাহের প্রস্তাবও দেবে না।»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৬- শরীর ও কাপড়ে সুগন্ধি লাগানো

ইহরাম পরার পর শরীরে অথবা কাপড়ে সুগন্ধি লাগানো নিষিদ্ধ। এমনকি ই”ছাকৃতভাবে সুগন্ধির ঘ্র্রাণ নেয়াও নিষিদ্ধ। ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত উল্লিখিত হাদীস এর দলিল: «তোমরা এমন কোনো কাপড় পরো না, যাকে জাআফরান অথবা র্ওস স্পর্শ করেছে।[র্ও]স: একপ্রকার সুগন্ধিযুক্ত হলুদ উদ্ভিদ যা দিয়ে রং করা হয়।]»(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম। ) এর আরেকটি প্রমাণ, মৃত মুহরিমের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,«তাকে সুগন্ধিযুক্ত করো না।»(বর্ণনায় বুখারী)

৭- বিবাহের আক্দ করা

উসমান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: «মুহরিম ব্যক্তি বিবাহ করবে না, বিবাহ দেবেও না, এমনকি বিবাহের প্রস্তাবও দেবে না।»(বর্ণনায় মুসলিম)

৮- মী-স্ত্রীর মিলন

আল্লাহ তাআলা বলেন:

(فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ )

{অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে রাফাস ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।} [সূরা আল বাকারা:১৯৭] রাফাস শব্দের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন যে তা হলো জিমা বা সঙ্গম। আর এ বিষয়টি হলো ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের মধ্যে সমধিক কঠিন নিষিদ্ধ বিষয়।

৯- মিলন ব্যতীত অন্যকোনো যৌনস্পর্শ

যেমন চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি; কেননা তা হারাম মিলনের উসিলা।

ইহরাম অবস্থায় নারীর জন্য যা নিষিদ্ধ

নারী ইহরামের নিষিদ্ধ বিষয়ের ক্ষেত্রে পুরুষের মতোই। তবে নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহে নারী পুরুষ থেকে ভিন্ন।

১- নারী সেলাই করা পোশাক পরতে পারবে।

২- নারী সেলাই করা পোশাক পরতে পারবে।

৩- নারী নেকাব ও হাত মোজা পরবে না; কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «মুহরিমা নারী নেকাব পরবে না এবং হাতমোজাও পরবে না।»(বর্ণনায় বুখারী)

তবে আজনবী পুরুষের মুখোমুখি হলে নারী তার চেহারা নেকাব ব্যতীত অন্যকিছু দিয়ে ঢেকে নেবে, যেমন মাথা থেকে কাপড় ঝুলিয়ে দেবে। নারীর জন্য স্বর্ণের অলংকার ব্যবহারও বৈধ রয়েছে।

কিছু দিকনির্দেশনা

১ - ইহরামের দু রাকাত সুন্নত নামাজ বলতে কিছু নেই। তবে যদি ফরজ নামাজ অথবা তাইহিয়াতুল উজুর পর ইহরামের নিয়ত করে তবে শরিয়তসিদ্ধ হবে। ইহরাম বাঁধার সময় বিশেষ কোনো দুআর কথাও শরীয়তে আসেনি।

২ - যদি মুসাফির বিমানে সফর করে এবং মিকাতে পৌঁছুলে ইহরাম পরতে সক্ষম হবে না বলে আশঙ্কা হয়, তাহলে বাসা থেকে অথবা বিমানবন্দর থেকে ইহরামের কাপড় পরে বিমানে উঠবে। এরপর যখন মিকাতের নিকটবর্তী হবে তখন নিয়ত করে নেবে। নিয়ত করার পূর্বে শুধু ইহরামের কাপড় পরলেই মুহরিম হিসেবে ধরা হবে না।

৩ - হাজ্বীদের মধ্যে এমনও রয়েছেন যারা ইহরাম পরার পরপরই তাদের ডান কাঁধ উন্মুক্ত করে রাখে। এ প্রক্রিয়ার নাম হলো ইযতিবা যা কেবল মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে কুদুমের সময় করতে হয়। পক্ষান্তরে অন্যসময় উভয় কাঁধ ঢেকে রাখতে হয়। তাই ইহরাম বাঁধার পরপরই ডান কাঁধ খুলে রাখা শুদ্ধ নয়|

নিয়তে শর্ত করা

যার কোনো রোগ রয়েছে, অথবা এমন কোনো ঘটনার আশঙ্কা করে যা তার হজ্বকর্ম বিঘ্নিত করবে, তবে এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো হইরামের সময় শর্ত করে নিয়ে বলা,«হে আল্লাহ, আমি উমরা (অথবা হজ্বের জন্য) আপনার আহবানে সাড়া দিয়েছি। তবে যদি কোনোকিছু আমাকে আটকে দেয়, তাহলে আমাকে যেখানে আটকে দেবেন সেটাই হবে আমার হালাল হয়ে যাওয়ার জায়গা। আয়েশা রাযি. বলেন,«রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবাআ বিনতে যুবাইর এর কাছে গেলেন। তিনি তাকে বললেন,«তুমি সম্ভবত হজ্বের ইচ্ছা করেছ? তিনি বললেন, «আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি নিজেকে অসুস্থ পাচ্ছি।» রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, «তুমি হজ্ব করো ও শর্ত করে নাও এবং বলো, «হে আল্লাহ, আমার হালাল হওয়ার জায়গা সেটা যেখানে আপনি আমাকে আটকে দেবেন।» কেউ যদি এরূপ বলে নেয় এবং পরবর্তীতে এমন বিষয়ের মুখোমুখি হয় যা তার হজ্বযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে দম ইত্যাদি ছাড়াই সে ইহরামমুক্ত হতে পারবে।

ইহরামের কিছু আহকাম

অজু অথবা গোসলের সময় মুহরিমের মাথা থেকে যদি গুটিকতক চুল পড়ে যায়, তবে এতে কোনো ক্ষতি নেই। তদ্র্রূপভাবে যদি দাঁড়ি-গোফ অথবা নখ থেকে কোনোকিছু পড়ে যায় তবে এতেও কোনো ক্ষতি হবে না, যদি মুহরিম ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তা করে না থাকে। আর এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান। অতএব নারীর কোনো চুল অথবা নখের কোনো অংশ পড়ে গেলেও তাতে কোনো ক্ষতি হবে না।

মুহরিমব্যক্তি কোমরে কোনোকিছু বাঁধতে পারবে যদি প্রয়োজন মনে করে।