কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে অথবা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ-বিষয়সমূহের কোনো একটি করে ফেললে হজ্বকারী অথবা উমরাকারীর করণীয়।
কোনো ওয়াজিবকর্ম ছেড়ে দেয়ার ফিদয়া
যে ব্যক্তি হজ্ব অথবা উমরার কোনো ওয়াজিব ছেড়ে দিল, যেমন মুযদালিফায় রাতযাপন অথবা মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা ছেড়ে দিল, তাহলে ফিদয়া প্রদান ওয়াজিব হবে। এ ফিদয়াকেই দম বলা হয়।
দম হলো পুরুষ অথবা স্ত্রীউটের একসপ্তমাংশ, গরুর একসপ্তমাংশ অথবা এক বছরের একটি বকরী অথবা ছয় মাসের একটি ভেড়া। দম যবেহ করার জায়গা হলো মক্কার পবিত্র এলাকা। দম যবেহ করে তার গোশত অত্র অঞ্চলের দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে।
দম যবেহ করতে সক্ষম না হলে দশদিন রোজা রাখতে হবে। তিনদিন হজ্ব পালনাবস্থায়, আর বাকি সাতদিন নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ-বিষয়সমূহের কোনো একটি করে ফেলার ফিদয়া
১ - সেলাই করা কাপড় পরিধান করা, মাথা ঢেকে রাখা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, মাথা মুণ্ডন করে ফেলা ও নখ কাটার ক্ষেত্রে নি¤œবর্ণিত তিনটি বিষয়ের যেকোনো একটি করতে হবে:
ক - তিন দিন রোজা রাখা।
খ - ছয় জন মিসকীনকে খাবার প্রদান করা। প্রতি মিসকীনকে অর্ধ সা» করে চাউল অথবা অন্য কোনো খাদ্য প্রদান করা।
{(আর তোমরা তোমাদের মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পেঁছে। আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোনো কষ্ট থাকে তবে সিয়াম কিংবা সদকা অথবা পশু যবেহ এর মাধ্যমে ফিদয়া দেবে।}[সূরা আল বাকারা:১৯৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম মুহরিম কাব ইবনে উজ্রাকে বললেন,«মাথার উকুন তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে?» সে বলল, জী, তিনি বললেন,«তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেল, অতঃপর কুরবানি হিসেবে একটি বকরী যবেহ করো। অথবা তিনি দিন রোজা রাখো অথবা তিন সা খেজুর ছয় জন মিসকীনকে দান করো।»(দুই মুদ: অর্ধ সা, যার ওজন ১০২০ গ্রাম।)
অতএব ইহরাম অবস্থায় উপরোল্লিখিত পাঁচ নিষিদ্ধ বিষয়ের কোনো একটি যে ব্যক্তি সেচ্ছায় অথবা বিশেষ কোনো প্রয়োজনবশত করে ফেলল, যেমনটি করতে হয়েছে কাব ইবনে উজ্রা রাযি. কে, এমতাবস্থায় তাকে ফিদয়া দিতে হবে। এ প্রকৃতির ফিদয়াকে ফিদয়াতুল আযা বা কষ্টজনিত ফিদয়া বলে। আর যে ব্যক্তি বিস্মৃতিবশত এসবের কোনো একটি করে ফেলবে তাকে কোনো কিছু দিতে হবে না।
২- স্ত্রীর গুপ্তাঙ্গের বাইরে অন্য কোথাও যৌন আস্বাদ নেয়া এবং প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞামুক্তির পর রতিক্রিয়া।
এ সবের ফিদয়া হবে উল্লিখিত ফিদয়াতুল আযা বা কষ্টজনিত ফিদয়া।
৩-প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞামুক্তির পূর্বে রতিক্রিয়া
এ অবস্থায় ফিদয়া হিসেবে একটি উট যবেহ করতে হবে। না পারলে হজ্বে তিন দিন এবং হজ্ব থেকে স্বদেশে ফিরে আসার পর সাত দিন রোজা রাখতে হবে। আর এ অবস্থায় বর্তমান হজ্ব পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে এবং পরবর্তী বছর তা কাযা করা আবশ্যক হবে।
৪-উমরা অবস্থায় রতিক্রিয়ার ফিদয়া
একটি বকরী ফিদয়া হিসেবে যবেহ করতে হবে। বর্তমান উমরা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে এবং তা কাযা করা আবশ্যক হবে।
৫-শিকার হত্যা করার ফিদয়া
যদি শিকারকৃত জন্তুর সম পর্যায়ের কোনো জন্তু পাওয়া যায় তাহলে ফিদয়া হিসেবে তা প্রদান করা অথবা এর মূল্যনির্ধারণ করে তা দিয়ে খাদ্য ক্রয় করে প্রতি মিসকীনকে দুই মুদ (১০২০ গ্রাম) করে দেয়া। না পারলে প্রতি দুই মুদের পরিবর্তে একটি করে রোজা রাখা।
শিকারকৃত জন্তুর সম পর্যায়ের জন্তু দ্বারা উদ্দেশ্য এমন জন্তু যা শিকারকৃত জন্তু সদৃশ অথবা তার কাছাকাছি। পূর্ণাঙ্গরূপে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া জরুরি নয়; কেননা তা অসম্ভব।
এর উদাহরণ: যদি কেউ একটি উটপাখি শিকার করে, তাহলে এর পরিবর্তে ফিদয়া হিসেবে একটি উট দিতে হবে; কেননা কিছু বিষয়ে উটপাখি উটের সদৃশ। অথবা উটপাখির মূল্যনির্ধারণ করে তা দিয়ে খাদ্য ক্রয় করে বিতরণ করতে হবে, যেমন চাল বা গম। প্রতি মিসকীনকে দুই মুদ করে খাদ্য বিলিয়ে দিতে হবে, অথবা প্রতি দুইি মুদের পরিবর্তে একদিন করে রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ বন্যগাধা শিকার করে, তবে এর পরিবর্তে একটি গাভী ফিদয়া হিসেবে দিতে হবে।
আর যদি শিকারকৃত জন্তুর কোনো সদৃশ না থাকে, যেমন ফরিং অথবা চড়ইপাখি। তাহলে তার মূল্যনির্ধারণ করে তা দিয়ে খাদ্য ক্রয় করে মিসকীনদেরকে বিলিয়ে দেয়া ও প্রতি দুই মুদের পরিবর্তে একদিন করে রোজা রাখার মাঝে ব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে। মূল্যনির্ধারণের ক্ষেত্রে দু জন ইনসাফগার অভিজ্ঞ লোকের আশ্রয় নিতে হবে|
ফিদয়া প্রদানের সময়
ফিদয়া প্রদানের কারণ সংঘটিত হলেই ফিদয়া প্রদান করতে হবে। ইহরামের নিষিদ্ধ-বিষয় সংক্রান্ত ফিদয়া হলে তা সংঘটিত হওয়ার পরপরই তা প্রদান করতে হবে। ওয়াজিব তরক সংক্রান্ত হলে যখন ওয়াজিব তরক হবে তখন ফিদয়া প্রদান করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: হাদী
হাদী
শিকারকৃত জন্তুর সম পর্যায়ের জন্তু দ্বারা উদ্দেশ্য এমন জন্তু যা শিকারকৃত জন্তু সদৃশ মক্কার পবিত্র অঞ্চলে কুরবানীকৃত গবাদি পশু।
হাদীর প্রকারভেদ
১- তামাত্তু ও কিরান হজ্বের হাদী
তামাত্তু ও কিরান হজ্বকারীর ওপর হাদী ওয়াজিব। আর তা হলো
একটি বকরী, অথবা উট বা গরুর একসপ্তমাংশ। না পারলে দশ দিন রোজা রাখতে হবে। তিন দিন হজ্বাবস্থায় এবং সাত দিন হজ্ব থেকে স্বদেশে ফিরে গিয়ে। যারা মক্কায় বসবাসকারী নয় তাদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য। আর যারা মক্কাবাসী তাদেরকে হাদীও দিতে হবে
না, রোজাও রাখাতে হবে না। এর দলিল আল্লাহ তাআলার বাণী :
{আর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যে ব্যক্তি উমরার পর হজ সম্পাদনপূর্বক তামাত্তু করবে, তবে যে পশু সহজ হবে, তা যবেহ করবে। কিন্তু যে তা পাবে না তাকে হজে তিন দিন এবং যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন সাত দিন সিয়াম পালন করবে। এই হল পূর্ণ দশ। এই বিধান তার জন্য, যার পরিবার মাসজিদুল হারামের অধিবাসী নয়। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ আযাবদানে কঠোর।}[সূরা আল বাকারা:১৯৬]
২-নফল হাদী
ইফরাদ হজ্বকারী অথবা উমরাকারী ঐচ্ছিকভাবে যদি হাদী প্রদান করে তবে এটাকে নফল হাদী বলে। তামাত্তু বা কিরান হজকারী ওয়াজিব হাদীর অতিরিক্ত যদি কোনো হাদী প্রদান করে, অথবা হাজ্বী ব্যতীত যদি অন্যকেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মক্কায় কোনো হাদী পাঠায় তবে সেটাও হবে নফল হাদী।
তামাত্তু, কিরান ও নফল হাদীর গোশত নিজে খাওয়া বৈধ রয়েছে। নিজে খাওয়া বরং মুস্তাহাব; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করেছেন। হাদীসে এসেছে, «রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক উট থেকে এক টুকরো গোশত নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর তা পাকানো হয়েছে এবং তিনি তার ঝোল পান করেছেন।»(বর্ণনায় বুখারী)
৩-ইহসারের হাদী
ইহসার হলো হজ্ব, উমরা অথবা উভয়টি পালনে বাধাগ্রস্ত হওয়া। যেমন কেউ হজ্ব অথবা উমরার ইহরাম করল, কিন্তু শত্রুরা তাকে বায়তুল্লায় প্রবেশ করতে দিল না, অথবা এমন কোনো দুর্ঘটনাকবলিত হলো যার কারণে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না। এমতাবস্থায় যেখানে বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেখানেই হাদী যবেহ করবে এবং ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। এর দলিল আল্লাহ তাআলার বাণী:
{অতঃপর যদি তোমরা আটকে পড় তবে যে পশু সহজ হবে (তা যবেহ কর}| [সূরা আল বাকারা:১৯৬]
ইহসারের হাদী হলো: একটি বকরী অথবা উট বা গাভীর একসপ্তমাংশ।
হাদী যবেহ করার জায়গা
তামাত্তু, কিরান হজ্বের হাদীসহ অন্যান্য নফল হাদী মক্কার পবিত্র অঞ্চনের সীমানার ভেতরে যবেহ করতে হবে। এ এলাকার মিসকীনদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। যদি কেউ মক্কার পবিত্র অঞ্চলের বাইরে যবেহ করে, তবে তা শুদ্ধ হবে না।
পক্ষান্তরে ইহসারের হাদী যবেহ করার জায়গা হলো যেখানে বাধাগ্রস্ত হয়েছে সে জায়গা।হাদী যবেহ করার সময়সীমা
১ - তামাত্তু, কিরান ও নফল হাদী
দশ যিলহজ্ব বড়-জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর থেকে শুরু হয়ে আইয়ামে নহরের শেষ দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাদী কুরবানী করা বৈধ। আইয়ামে নহরের শেষ দিন হলো হানাফী মাযহাব অনুযায়ী ১২ যিলহজ্ব এবং জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ যিলহজ্ব|
২ - ইহসারের হাদী
ইহসারের হাদী যবেহ করার সময় হলো যে সময় বাধাগ্রস্ত হবে সে সময়।
হাদী ও কুরবানী যবেহ-বিষয়ক কিছু আহকাম
হাদী যবেহ করার ব্যাপারে তামাত্তু ও কিরানকারী হাজ্বী অন্যকাউকে প্রতিনিধি বানাতে পারবে, যদি প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি বিশ্বস্থ ও নির্ভরযোগ্য হয়। তবে হাজ্বী যদি নিজের হাদী নিজেই যবেহ করে তাই হবে উত্তম।
ফিদয়া, কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে না; কেননা ফিদয়া হলো সুযোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে প্রদেয় পশু, আর কুরবানী হলো হাজ্বী ও গায়রে হাজ্বী সবার জন্য।